শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪
সম্পূর্ণ খবর
Riya Patra | ১১ এপ্রিল ২০২৪ ১৮ : ৫৮Riya Patra
বিভাস ভট্টাচার্য
১৯৭২ সালে বরানগর বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জ্যোতি বসু। ভোট লুটের অভিযোগে তিনি ওই বছর নির্বাচন শুরুর কিছু পরেই প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। তারপর থেকেই এই কেন্দ্রে সিপিএম আর প্রার্থী দেয়নি। দীর্ঘ ৫২ বছর পর ২০২৪ সালে বরানগর বিধানসভার উপনির্বাচনে প্রার্থী হলেন সিপিএমের তন্ময় ভট্টাচার্য।
* এত বছর পর। একটু কি চাপে আছেন?
তন্ময়: প্রথমত আমি ওটা ১৯৭২ সালের পর বলব না। ১৯৭১ সালের পর বলব। ১৯৭২ সালে নির্বাচন চলাকালীন সকাল সাড়ে ন"টায় জ্যোতি বসু প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ৭২-এর নির্বাচনকে আমরা নির্বাচন বলেই মনে করি না। ফলে ১৯৭১ সালের পর ৫৩ বছর বাদে বরানগরের মানুষ জ্যোতি বসুর প্রতীক কাস্তে, হাতুড়ি ও তারা চিহ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। নিশ্চিতভাবেই এটা আমার কাছে খুব গর্বের এবং বরানগরের মানুষের কাছে এই প্রতীকের মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
* ৭২ সালের ওই নির্বাচনে জিতেছিলেন সিপিআইয়ের প্রার্থী শিবপদ ভট্টাচার্য। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট লুটের অভিযোগ ওঠে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় আসে তখন দেওয়ালে লেখা হত, "৭২-এর কালো দিনগুলো ফিরে আসতে দিচ্ছি না, দেব না"। সেই কংগ্রেস আজ সিপিএমের হয়ে ভোটের প্রচারে যাবে। এটা কি সময়ের পরিহাস না আপনার কাছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা?
তন্ময়: দেখুন, পরিহাস বলে কোনও শব্দ রাজনীতিতে হয় না। রাজনীতি হল নীতির লড়াই। কোনও একটা সময়ে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে ঠিক করতে হয় তারা সেইসময় দেশের রাজনীতিতে মূল বিপদ হিসেবে কাকে চিহ্নিত করছে। এই বিপদটাকে আরও যাঁরা চিহ্নিত করতে চান, তাঁদের সকলকে এক করাটা সেই রাজনৈতিক দলের কাজ। এইমুহূর্তে আমাদের দেশের মূল বিপদ হল সংবিধান বিপন্ন। তাকে বাতিল করে মনু সংহিতাকে আমাদের দেশের সংবিধান করার চেষ্টা হচ্ছে। আরএসএস-এর স্লোগান এক দেশ, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক দেবতা, এক দল, এক নীতি। ভারতবর্ষ বরাবর বহুত্ববাদের পূজারি। প্রকৃতি বা সভ্যতাও এই একমুখী বিষয়টি মানে না। এই রাজ্য যারা শাসন করছে তারা কার্যত বিজেপির দোসর। বহু ঘটনার মধ্য দিয়েই এটা প্রমাণিত। তৃণমূলের শাসন মানে সর্বস্তরের দুর্নীতি।
* যে কংগ্রেসের জন্য জ্যোতি বসু তাঁর প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন এই কেন্দ্রে আজ সেই কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে বেরোচ্ছেন। কোথাও কি পুরনো স্মৃতি আপনাকে তাড়া করছে?
তন্ময়: সেই কংগ্রেস দলের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল এবং সবচেয়ে হিংস্র অংশটাই হল তৃণমূল। প্রগতিশীল অংশটা রয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে। ফলে সেই প্রগতিশীল অংশটা যারা ধর্ম নিরপেক্ষতার পক্ষে এবং যারা দেশের সংবিধানের পক্ষে রয়েছে, তাদের সঙ্গে দেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাঁচানোর জন্য একসঙ্গে চলা যায় বলে আমরা বিশ্বাস করি।
* ৭২ সালের পর দীর্ঘদিন এই কেন্দ্রে আরএসপি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছেন। এবার তারা প্রার্থী জোগাড় করতে পারল না বলেই শোনা যাচ্ছে। সেইজন্যই কি আপনাকে সিপিএম প্রার্থী করল?
তন্ময়: বামফ্রন্টের সর্বোচ্চ স্তরে বসে এবং জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনা করে কোন আসনে কে লড়বে সেটা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেবেই এই কেন্দ্রে সিপিএম লড়বে এটা ঠিক হয়েছে এবং দল আমাকে প্রার্থী করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
* ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল এখানে জিতে আসছে। পুরোটাই কি মমতা ব্যানার্জির ক্যারিশমা নাকি তাঁরা কাজ করে মানুষের থেকে ভোট আদায় করে নিচ্ছেন?
তন্ময়: ২০১১ সালের নির্বাচন বামপন্থীদের বিরুদ্ধে ছিল। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর একটা "অ্যান্টি ইনকামবেন্সি" ফ্যাক্টর কাজ করে। নিশ্চিতভাবেই দলের একটা অংশের ঔদ্ধত্য এবং জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতা মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
* এই অংশ বলতে কাদের কথা বলতে চাইছেন?
তন্ময়: ধরুন লোকাল কমিটি বা জোনাল কমিটির নেতৃত্বের একটা অংশ বা জেলা কমিটির নেতৃত্বের একটা অংশ। এরকমভাবে ধরতে পারেন। সকলের না হলেও তাঁদের কারুর কারুর মধ্যে একটা ঔদ্ধত্য দেখা গিয়েছিল। আমাদের কিংবদন্তী নেতা জ্যোতি বসু বলতেন মানুষের কাছে যাও। যেটা করতে পেরেছো সেটার সঙ্গে যেটা পারোনি সেটাও বলো। কিন্তু মানুষের কাছে যাওয়াটা কমে গেছিল। ৩৪ বছর সরকারে থেকে একটা অংশের মনে হয়েছিল, আমি কেন মানুষের কাছে যাব! মানুষ আসবে আমার কাছে। বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর একজন দায়িত্ব পান, কিন্তু কেউ যদি মনে করেন তিনি ক্ষমতা পেলেন, তখনই জনবিচ্ছিন্নতা শুরু হয়। ২০১১তে মানুষ ঠিক করেছিলেন একবার বামেদের পরিবর্তন করে দেখা যাক। সেই রায় আমরা মাথা পেতে নিয়েছি। কিন্তু বিষয়টা হল ভালো কিছুর জন্যই তো মানুষ বদলান। আমাদের বদল করে মানুষ কি ভালো কিছু পেলেন? অভিজ্ঞতা বলছে, তাঁরা সেটা পাননি। ২০১৬ সালেই কিন্তু মানুষের মধ্যে এই উপলব্ধিটা চলে এসেছিল। ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে তৃণমূলের সঙ্গে গোটা রাজ্যে আমাদের ভোটের ব্যবধান অনেকটাই কমে যায়। অর্থাৎ যেটা ছিল "নো টু লেফট" সেটাই হয়ে গেল "নো টু টিএমসি"। কিন্তু ২০১৯ এবং ২০২১ সালে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সুযোগটা পেয়ে গেল বিজেপি।
* এটা কি আপনাদের ব্যর্থতা?
তন্ময়: নিশ্চয়ই আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু আজ মানুষ বুঝতে পেরেছেন, ওই চা ওয়ালা ফকির আদমি নন। তিনি ২৮ জন শিল্পপতিকে দেশের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে যেতে দিয়েছেন। তিনি ১১ লক্ষ কোটি টাকা বড়লোকদের ঋণ ছাড় দিয়েছেন। ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে ৯৭০০ কোটি টাকা তুলেছেন আর তৃণমূল তুলেছে ১৬০০ কোটি টাকা। যার জন্য দেশে বাড়ছে ওষুধের দাম এবং রাজ্যে বাড়ছে দুধ ও বিদ্যুতের দাম।
* ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে আপনারা একটা টাকা নেননি এটা ঠিক, কিন্তু সিপিএম কি কখনও কোনও শিল্পপতির থেকে একটাকাও চাঁদা নেয়নি?
তন্ময়: আগে যে নিয়মটা ছিল সেটায় কে দিচ্ছে এবং কে নিচ্ছে, সেটা সবটাই জানা যেত। ইলেক্টোরাল বন্ড গোটা বিষয়টি একটা গোপনীয়তার মোড়কে ঢেকে দিল।
* সিপিএম কি কোনওদিন শিল্পপতিদের থেকে টাকা নেয়নি?
তন্ময়: গোপনীয়তার সঙ্গে টাকা নেওয়ার আমরা সবসময় বিরুদ্ধে। আমাদের করা মামলার রায়েই আজ দেশ জানে ওই বন্ডের মাধ্যমে কে টাকা নিয়েছে আর কে দিয়েছে। আমরা বিল ছাড়া কোনওদিন কারুর থেকে একটা টাকাও নিইনি।
* দমদম উত্তর বিধানসভায় ২০১৬ সালে আপনি জিতেও ২০২১এ কেন তিন নম্বর স্থানে চলে গেলেন? বিজেপি দ্বিতীয় স্থানে চলে গেল। কেন্দ্রে কি ঠিকঠাক কাজ করতে পারেননি?
তন্ময়: সবচেয়ে বেশি কাজ আমি করেছিলাম। আমিই একমাত্র বিধায়ক যে ওই বিধানসভায় ৩ কোটি টাকা খরচ করে তার ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলাম।
* তাহলে হারলেন কেন?
তন্ময়: আসলে একটা "বাইনারি" বা ধারণা তৈরি করা হল যে তৃণমূলকে বিজেপিই হারাতে পারে। যার শিকার গোটা রাজ্যে সবাই হয়েছে। আমিও হয়েছি।
* আপনি ভূমিপুত্র। কিন্তু তাপস রায় তো ভূমিপুত্র না হয়েও এই কেন্দ্র থেকে পরপর তিনবার জিতেছেন। এটা কীভাবে হচ্ছে?
তন্ময়: জ্যোতি বসু ভূমিপুত্র না হয়েও এখানে ছ"বার জিতেছেন। আরও অনেকেই জিতেছেন।
* তার অর্থ ভূমিপুত্র বিষয়টি খুব একটা বড় ব্যাপার নয়?
তন্ময়: ঘটনাচক্রে বরানগর বিধানসভা কেন্দ্র কোনওদিন কোনও ভূমিপুত্র পায়নি। এবার বরানগরের কাছে এই সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগ মানুষ সদ্ব্যবহার করবেন কিনা সেটা তো তাঁদের সিদ্ধান্ত।
* প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি ও তৃণমূল প্রার্থীকে আপনি কত নম্বর দেবেন ?
তন্ময়: তাঁরা দুজনই বাইরে থেকে বরানগরে এসেছেন। আমি আমার শুভেচ্ছা জানাব। দুজনকেই অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করব। কিন্তু রাজনীতির লড়াইটা আমি রাজনীতি দিয়েই করব।